হাইয়া সোফিয়া নির্মাণের অঙ্ক কষেছিলেন দুই গ্রীক গণিতজ্ঞ; অ্যান্থেমিয়াস আর ইসিদোর। সে এক মস্ত অট্যালিকা নির্মাণের অঙ্ক। প্রাচীন দুনিয়ার অষ্টম বিস্ময়। তাকে গড়তে যে বেশ জটিল গণিত কষতে হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবু অবাক হয়েছি। কারণ একটা পিলে চমকানো সমবাহু সপ্তভুজ!
এই রহস্যময় সপ্তভুজের গল্প লিখছি। প্রাচীন জ্যামিতির এই মহাসমারোহ থেকে আমরা নবীনরা হয়ত কিছু শিখতে পারব। মগজের কোষগুলো রসদ পাবে।
ছিলো চার্চ প্রায় ৯০০ বছর। হয়েছিল মসজিদ তারপর ৫০০ বছর। মাঝখানে বছর ৮০ সে ছিলো বিলকুল সেকুলার মিউজিয়াম। ২০২০ সালে সে আবার মসজিদ হয়েছে। এ হেন হাইয়া সোফিয়ায় পা ফেললে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। বসফরাস সাগরের তীরে সহস্রাব্দ প্রাচীন মহাঅট্যালিকা। আক্ষরিক অর্থে সে পবিত্র জ্ঞানের মন্দির। যীশু খ্রীষ্টের প্রতি সমর্পিত উপাসনালয়। ১১০০০ ক্রীতদাসের হাতে গড়া দেবতার ঘর।
হাইয়া সোফিয়ার একদম কেন্দ্রে আছে এক অদৃশ্য সপ্তভুজ। উইকিপিডিয়ায় সম্ভবত তার উল্লেখ নেই। কিন্তু আধুনিক কিছু গবেষণাপত্রে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। গড়নটা দেখে একটা খটকা লেগেছিল। একটু পড়ে দেখলাম ভাবনাটা মিথ্যা নয়।
অদৃশ্য সপ্তভুজের অস্তিত্ত্ব বুঝতে গেলে একটু মাথা খাটাতে হবে। হাইয়া সোফিয়ার ব্যাসিলিকা (প্রধান সভাঘর)-এর মাঝখানটা একটা লম্বাটে চতুর্ভুজ। সেই চতুর্ভুজের পুব বাহুতে একটা অর্ধগোলাকার অংশ জুড়ে গেছে। এই অংশকে খ্রীষ্টানরা বলেন অ্যাপস (apse)। অর্থোডক্স খ্রীষ্টানরা এ্যাপসের মাঝখানে বেদী গড়তেন। সেই বেদীতে (অলটারে) বলি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। মসজিদ হওয়ার পর অবশ্য সেই অলটারের অস্তিত্ত্ব মুছে গেছে।
প্রাচীন চার্চে ব্যাসিলিকার এই হত গড়ন। অ্যাপসের আকৃতি অর্ধগোলাকার। আগেই বলেছি যে সে সভাগৃহের চতুর্ভুজ মধ্যভাগের সাথে জুড়ে থাকে। এই অর্ধগোলাকার অংশকে যদি মনে মনে পূর্ণবৃত্ত করে দেওয়া যায়, তাহলে তাকে circumscribe করে (অর্থাৎ ঘিরে) থাকবে একটা কাল্পনিক বহুভুজ। এই বহুভুজকে নির্মাণের পর আর চোখে দেখা যায় না। শুধু তার কয়েকটা বাহু বরাবর দেওয়াল নির্মিত হয়। সেসব দেয়ালে বড় বড় জানলা থাকে। নির্মাতারা এমন ভাবে এই জানলাগুলো বানাতেন আর এ্যাপসের দেয়াল এমন এ্যাঙ্গেলে (কোণে) নির্মাণ করতেন যে বিশেষ মাহেন্দ্রক্ষণে সূর্যের আলোকরশ্মি বলির বেদীতে (অলটারে) প্রক্ষিপ্ত হত। সম্ভবত দেবতার ঘরকে আরও অপার্থিব রূপ দেওয়ার জন্য এসব কাণ্ড করা হত।
অন্যান্য চার্চে এই (অদৃশ্য) বহুভুজটা (যে কিনা অ্যাপসকে ঘিরে আছে) সাধারণত পঞ্চভুজ অথবা ষড়ভুজ হত। কারণটা একদম গাণীতিক। কম্পাস আর স্ট্রেটএজ (অর্থাৎ দাগ না দেওয়া রুলার) দিয়ে সমবাহু বহুভুজ যদি আঁকতে চাও তাহলে ত্রিভুজ আঁকতে পারবে, চতুর্ভুজ পারবে, পঞ্চভুজ পারবে, ষড়ভুজ পারবে, কিন্তু সপ্তভুজ পারবে না!
কেন পারবে না?
সেটা বুঝতে মানুষের প্রায় ২০০০ বছর সময় লেগেছে।
বাহুর দৈর্ঘ্য যদি constructible সংখ্যা হয়, তবেই তাকে কম্পাস আর স্ট্রেটএজ দিয়ে আঁকা সম্ভব। কাকে বলে কন্সট্রাকটিবল সংখ্যা? যদি তুমি সংখ্যাটাকে সসীম গোটা সংখ্যার (finite number of integer) যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ আর বর্গমুল দিয়ে লিখতে পারো তবেই সে হবে constructible। প্রমাণ করা সম্ভব যে একমাত্র এই ধরণের দৈর্ঘ্যকেই কম্পাস আর স্ট্রেটএজ দিয়ে আঁকা যায়। যদিচ এটা প্রমাণ করতে মানুষের হাজার হাজার বছর সময় লেগেছে। সমবাহু সপ্তভুজের বাহুর দৈর্ঘ্য কন্সট্রাক্টিবল নয়। তাই তাকে কম্পাস আর স্ট্রেটএজ দিয়ে আঁকা যায় না।
অতএব বুঝতেই পারছ যে এ্যাপসের বাইরে যে অদৃশ্য সমবাহু সপ্তভুজ এ্যান্থেনিয়াম আর ইসেদোর গড়েছিলেন তার নিঁখুত নির্মাণ কম্পাস আর স্ট্রেটএজ দিয়ে সম্ভব হত না। তাহলে কি ভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন তারা?
জ্যামিতিতে আরেক রকমের (নির্মাণ) কন্সট্রাকশন হয়। এই কনস্ট্রাকশনটার উদ্ভাবক সম্ভবত আর্কিমিডিস। একে বলে neusis construction। এই পদ্ধতিতে সমবাহু সপ্তভুজ আঁকা যায়। হাইয়া সোফিয়ার স্থপতিরা এই পদ্ধতি জানতেন বলেই মনে হয়। এই কায়দায় অনেক ভাবেই সমবাহু সপ্তভুজ আঁকা যায়। আধুনিক কালে জেভিড জনসন লিইস্ক একটা কায়দা বার করেছেন। এই ভদ্রলোক শখের গণিতজ্ঞ। প্রথম জীবনে কমিক্স আঁকতেন, ছোটদের জন্য লিখতেন। পরে গণিতে আগ্রহ জন্মায়। গণিত এবং চিত্রকলা নিয়ে এসারের মত এঁর কাজও প্রখ্যাত।
জনসনের কায়দাটা খানিকটা এরকম (ছবির সাথে মিলিয়ে নিতে পারো) –

রুলারের ওপর দুটো দাগ দিয়ে নাও। দাগ দুটো একে অপরের ১ ইঞ্চি তফাতে থাকবে।
কাগজে একটা রেখাংশ, AB, আঁকো (১ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য)। তার ওপরে AC লম্ব আঁকো। তারপর BC জুড়ে দাও। এবার B-কে কেন্দ্র আর BC-কে রেডিয়াস করে একটা বৃত্ত আঁকো। AB-র কেন্দ্রবিন্দুতে AB-র ওপর একটা লম্ব L আঁকো।
এবার নিউসিস করতে হবে। অর্থাৎ এক ইঞ্চি সমান একটা দৈর্ঘ্য-কে খাপে খাপে বসাতে হবে। প্রথমে A বিন্দুর ওপর স্কেলটা লম্ব ভাবে বসাও। তারপর A বিন্দুর দিকে রুলারটা হাত দিয়ে চেপে রেখে স্কেলের অপর মুখটা ঘোরাতে থাকো। এমন একটা জায়গা অবধি ঘোরাও যাতে স্কেলের মধ্যে এক ইঞ্চি মাপটার একটা ডগা L-এর ওপর থাকে আর একটা ডগা ঠিক বৃত্তের ওপর। যে ডগাটা L- কে ছেদ করল তার নাম দাও D। এবার ADB-র ওপর একটা বৃত্ত আঁকো আর AB-কে একটা বাহু করে সমবাহু সপ্তভুজ এঁকে ফেলো।
হাইয়া সোফিয়ার দুই স্থপতি সম্ভবত এরকম কোনো একটা পদ্ধতি জানতেন। তাই তারা সমবাহু সপ্তভুজ গড়তে পেরেছিলেন। ফলাফলটা হয়েছিলো দৃশ্যত অলৌকিক।
পঁচিশে ডিসেম্বরে, দিনমানের তৃতীয় প্রহরে, সূর্যের আলো ঠিক হাইয়া সোফিয়ার অলটারে এসে পড়ত। এই সময়টা খ্রীষ্টানদের মতে একটা পবিত্র কালখন্ড। বলে রাখা ভালো, প্রাচীনকালে ঘন্টা মিনিটের হিসেবটা একটু অন্যরকম ছিলো। দিন সবসময়েই বারো ঘন্টার, রাতও বারো ঘন্টার। অতএব ঋতু অনুসারে ঘন্টার মাপ ছোটবড় হত। পঁচিশে ডিসেম্বরের প্রবল শীতে প্রভাতের তৃতীয় ঘন্টা ইস্তানবুলে ঠিক কখন হবে, সে সময় সূর্যের আলো কোন এ্যাঙ্গেলে পড়বে, তার একটা জটিল হিসেব কষে নির্মাতার এ্যাপস বানিয়েছিলেন। সপ্তভুজ গড়তে হয়েছিল সেই কারণেই।

Leave a Reply